সন্তানকে যে বিষয়সমূহ অবশ্যই শেখানো উচিত
সন্তানের মধ্যে যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চেতনা ও শিষ্টাচারসমূহকে সঞ্চারিত করে যেতে হবে
লুকমান নামে গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্ব প্রাচীন আরবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। স্নেহের সন্তানকে এমন কিছু উপদেশ তিনি দিয়ে গিয়েছেন যা আজও প্রত্যেক পিতামাতার জন্য অনুকরণীয় হয়ে রয়েছে।
আল্লাহর একত্ববাদের ব্যাপারে নিজ সন্তানকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় লুকমানের এই উপদেশমালা। তার প্রথম সেই উপদেশটিকে উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন: وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ “(এবং সেই সময়কে স্মরণ কর) যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশচ্ছলে বলেছিল, হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চিত জেন, শিরক করা মহা অন্যায়।” [কুরআন ৩১:১৩]
দুনিয়ার এই জীবনে কারও সন্তান সফলতার যত শিখরে আরোহন করে থাকুক না কেন, আল্লাহকে সে সঠিকভাবে চিনতে না পারলে তার বাদবাকি সব অর্জনই ব্যর্থ, কেননা কবরে সে কিছুই নিয়ে যেতে পারবে না, একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে যা করা হয়েছে তা ব্যতীত।
আল্লাহর একত্বের ব্যাপারে লুকমানের দেওয়া এই উপদেশটি কুরআনের সূরা লুকমানে বর্ণনা করার পরপরই পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের বিষয়ে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া কয়েকটি নির্দেশনা বিবৃত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ “আর আমি মানুষকে তার পিতামাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি – (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে – তুমি কৃতজ্ঞতা আদায় করো আমার এবং তোমার পিতামাতার। আমারই কাছে (তোমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে।” [কুরআন ৩১:১৪]
তবে, পিতামাতা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতে বাঁধা প্রদান করেন তাহলে এই বিষয়ে তাদেরকে মানা যাবে না। আল্লাহ বলেন: وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا “তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না।” [কুরআন ৩১:১৫]
শেষ বিচারের দিনে আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে। পিতামাতা বা সন্তান কেউ সেদিন কারও কাজে আসবে না। আল্লাহ বলেন: يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَّا يَجْزِي وَالِدٌ عَن وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَن وَالِدِهِ شَيْئًا ۚ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُورُ “হে মানুষ! নিজ প্রতিপালক (-এর অসন্তুষ্টি) থেকে বেঁচে থাক এবং সেই দিনকে ভয় কর যখন কোনো পিতা তার সন্তানের কাজে আসবে না এবং কোনো সন্তানেরও সাধ্য হবে না তার পিতার কিছুমাত্র কাজে আসার। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় ফেলতে না পারে এবং সর্বাপেক্ষা বড় প্রতারক (শয়তান)-ও যেন আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকা দিতে না পারে।” [কুরআন ৩১:৩৩]
পিতামাতার কথার অন্ধ অনুসরণ করে অন্যায় কিছু করা থেকে বিরত থাকার এই নির্দেশ আল্লাহ আমাদেরকে দিলেও একইসাথে তাদের সাথে সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখতেও আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا “… তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে।” [কুরআন ৩১:১৫]
অনুসরণ ও অনুকরণের যোগ্য তো কেবলমাত্র তারাই যারা আল্লাহকে মেনে চলেন। আল্লাহ বলেন: وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ “এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন কর, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে।” [কুরআন ৩১:১৫]
পিতামাতার প্রতি কর্তব্য এবং নিজ সিদ্ধান্ত ও কর্মের বিষয়ে নিজের দায়িত্বশীলতা – এই দুটি বিষয়কে আমরা অনেকেই গুলিয়ে ফেলি। তাদেরকে সম্মান করা ও তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং অন্ধভাবে তাদের আনুগত্য করা থেকে বিরত থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়। বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তিকে এই উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে চলতে শিখতে হবে। নিজ সন্তানকেও তা শেখাতে হবে।
পিতামাতা প্রসঙ্গে আল্লাহর এই নির্দেশনাসমূহ শুনিয়ে দেওয়ার পর সূরা লুকমানের চলমান আলোচনাটি আবারও ফিরে গিয়েছে নিজ সন্তানের প্রতি দেওয়া লুকমানের উপদেশমালাতে। লুকমান বলেন: يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ “হে বৎস! কোনো কিছু যদি সরিষার দানা বরাবরও হয় এবং তা থাকে কোনো পাথরের ভেতর কিংবা আকাশমন্ডলীতে বা ভূমিতে, তবুও আল্লাহ তা উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সূক্ষ্ণদর্শী, সবকিছুর খবর রাখেন।” [কুরআন ৩১:১৬]
আল্লাহ সব দেখেন। সব শোনেন। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে কিছু করতে কেউ সক্ষম নয়। প্রকাশ্যে কিছু করা হোক বা গোপনে, আল্লাহর ফেরেশতারা সবই লিপিবদ্ধ করে রাখছেন – এই সচেতনতাটুকু নিজ সন্তানের মধ্যে অবশ্যই সঞ্চারিত করে যেতে হবে।
একইসাথে, তাদেরকে নামাযী বানানোর ব্যাপারেও সদা তৎপর থাকতে হবে। লুকমান নিজ সন্তানকে বলেছিলেন: يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ “হে বৎস! নামায কায়েম কর।” [কুরআন ৩১:১৭]
কেবলমাত্র নিজে ভালো হয়ে চললে হবে না, অন্যদেরকেও সুপথের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। মন্দ কিছু ঘটতে দেখলে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তা প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে। স্নেহের সন্তানকে এরপর এই শিক্ষাটি দিয়ে লুকমান বলেন: وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ “(হে বৎস!) মানুষকে সৎকাজের আদেশ কর, মন্দ কাজে নিষেধ কর।” [কুরআন ৩১:১৭]
মানুষকে সুপথে আনতে গিয়ে তাদেরই কাছ থেকে কটু কথা শোনা লাগতে পারে। আরও বড় কোনো বাধাবিঘ্নও সামনে আসতে পারে। ধৈর্য ধরে এসব সহ্য করে নিজের উদ্দেশ্যে অটল ও অবিচল থাকতে হবে। এই প্রসঙ্গে আগে থেকেই সাবধান করে দিয়ে লুকমান বললেন: وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ “(হে বৎস!) … এবং তোমার যে কষ্ট দেখা যায় তাতে সবর কর। নিশ্চয়ই এটা অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ।” [কুরআন ৩১:১৭]
অন্যকে সুপথে আহ্বান করতে গিয়ে নিজের মধ্যে এক প্রকার অহংকার চলে আসতে পারে। বৈষয়িক অবস্থানগত কারণেও মনের মধ্যে অহংকারের উদয় হতে পারে। অন্তরের মারাত্নক এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়ে লুকমান উপদেশ দিলেন: وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ “(হে বৎস!) অহংকারবশে মানুষকে তুমি অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে দর্পভরে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” [কুরআন ৩১:১৮]
সেইসাথে, চলাফেরা ও কথাবার্তার মৌলিক কিছু আদবকায়দাও আদরের সন্তানকে তিনি শিখিয়ে গিয়েছিলেন। লুকমান উপদেশ দিয়েছিলেন: وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ “(হে বৎস!) নিজ পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং নিজ কন্ঠস্বর সংযত রাখ। নিশ্চয়ই গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।” [কুরআন ৩১:১৯]
বিজ্ঞ ব্যক্তি লুকমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদেরও উচিত নিজ সন্তানের মধ্যে এই বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চেতনা ও শিষ্টাচারসমূহকে সঞ্চারিত করে দিয়ে যাওয়া। আমরা যারা পিতামাতা হয়েছি তাদের কর্তব্য এতটুকুই। এরপর বড় হয়ে তারা যা করবে তার জবাব তাদেরকেই দিতে হবে।