করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পরিহারযোগ্য প্রতিটি ধর্মীয় জমায়েত সাময়িকভাবে পরিহার করে চলুন
এই মুহুর্তে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা অধিকতর প্রাধান্য পাওয়া উচিত
কোভিড-১৯ নামের করোনাভাইরাসটি মানবদেহে প্রথম শনাক্ত করা হয় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে, চীনের হুবেই প্রদেশে। মাস দুয়েকের মধ্যে প্রাদেশিক রাজধানী উহানে নতুন এই ভাইরাসটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
কোভিড-১৯ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। ফলে, ভাইরাসটির বাহককে অন্যান্য মানুষ থেকে আলাদা করে ফেলতে না পারলে এর সংক্রমণ ঠেকানো খুবই কঠিন। অনেকটা বসন্ত রোগের মতো।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ সংক্রামিত প্রতি ১০০ জনে ৮০ জন এতে মৃদু মাত্রায় আক্রান্ত হবে এবং সেরেও উঠবে। বাকী ২০ জন অপেক্ষাকৃত কঠিন আক্রমণের শিকার হবে। এদের প্রায় প্রত্যেককে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগতে পারে। একটি এলাকায় একসাথে অনেক মানুষ এই ভাইরাসের শিকারে পরিণত হলে এবং তাদের পাঁচজনে একজনকে অন্যান্য রোগীদের থেকে পুরোপুরি পৃথক রেখে সেবা দেওয়া লাগলে সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেই চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাবে। এই ২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিতে পারলে এদের মধ্যে ১৩-১৪ জন হয়তো সুস্থ হয়ে যাবে। বাকী ৬ জনের অবস্থা হবে সঙ্কটাপন্ন। এদের মধ্যে কেউ মারা যাবে। যারা বেঁচে থাকবে তারা হয়তো আর কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠবে না।
এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যাচ্ছে তাতে চল্লিশের নিচে যাদের বয়স তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা ০.২০%, অর্থাৎ প্রতি ১,০০০ জনে ২ জন। চল্লিশের উপরে কিন্তু পঞ্চাশের নিচে যাদের বয়স তাদের এতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা ০.৪০%, অর্থাৎ প্রতি ১,০০০ জনে ৪ জন। পঞ্চাশের উপরে কিন্তু ষাটের নিচে নিচে যাদের বয়স তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১.৩০%, অর্থাৎ প্রতি ১,০০০ জনে ১৩ জন।
ষাটের উপরে যাদের বয়স তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের ৩.৬০%, ৭০ থেকে ৭৯ বছর বয়সীদের ৮% এবং ৮০-উর্ধদের ১৪.৮০% এতে মারা যেতে পারেন। এদের মধ্যে যারা বেঁচে যাবেন তাদের অনেকের শরীরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ঠিকমতো কাজ না-ও করতে পারে।
আমাদের প্রায় প্রত্যেকের পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আছেন। আরও অনেকে আছেন যাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। এদের কথা চিন্তা করে হলেও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের প্রত্যেককে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
ভাইরাসটির সম্ভাব্য বাহকদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। এই পরিস্থিতিতে বেশি লোকের সমাগম হয় বা অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা বেশি এমন সব স্থান সাময়িকভাবে হলেও যথাসম্ভব পরিহার করে চলা উচিত। গণপরিবহণ, বিপনিবিতান, বিনোদনকেন্দ্র, সমাবেশস্থল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দাওয়াত, জটলা – এই সবই এর মধ্যে পড়ে।
ধার্মিক ব্যক্তিদের বিভিন্ন জমায়েতও পরিহারযোগ্য এসব স্থানের তালিকার মধ্যে পড়ে। এখানেও একই স্থানে একসাথে নানা বয়েসী অনেক মানুষের কাছাকাছি সমাবেশ ঘটে। ফলে, এখান থেকেও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনাভাইরাস। পরিহারযোগ্য এমন প্রতিটি ধর্মীয় জমায়েত থেকে সবাইকে দূরে রাখতে না পারলে অচিরেই তা বড় ধরণের একটি বিপদ ডেকে আনতে পারে।
চীনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া হলো প্রথম দেশ যেখানে করোনাভাইরাস বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ২রা মার্চ ২০২০ পর্যন্ত সময়ে দেশটিতে যত মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয় তার ৬০% ছিলেন একটি নির্দিষ্ট খ্রিস্টিয় চার্চের সদস্য। তাদের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে গোটা দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি ভাইরাসটি ইরানেও বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। শিয়া মুসলিমদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শহর কোম থেকেই ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় যে, চীনের উহান সফর করে আসা কোনো তীর্থযাত্রীর হাত ধরে কোম শহরে করোনাভাইরাসের আগমন। শিয়া মতাবলম্বীরা মাযারের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন। তাদের অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কোম বা মাশহাদের গুরুত্বপূর্ণ মাযারসমূহে করোনাভাইরাস তো ছড়াবেই না, বরং সেখানে গেলে এর সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা যাবে। বাস্তবে হয়েছে উল্টো। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করার ফলে সেখানে আগত লোকদের মাধ্যমেই করোনাভাইরাস আরও বেশি করে ছড়িয়েছে, যা পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।
শুধু শিয়া নয়, সুন্নি মুসলিমদের ধর্মীয় সমাবেশ থেকেও কোভিড-১৯ অনেক মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রী পেতালিং-এর মসজিদ জামে-তে ২০২০ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১লা মার্চে অনুষ্ঠিত তাবলীগি জামাতের ইজতেমায় যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অনেকের শরীরে সেখানে অংশগ্রহণকারী কারও মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রামিত হয়েছে। সেই জীবানু তারা বহন করে নিয়ে গেছেন গোটা মালয়েশিয়াতে, এমনকি প্রতিবেশী দেশসমূহেও।
কোভিড-১৯ মশাবাহিত কোনো রোগ নয় যে মশা নির্মূল করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এর কোনো টিকা বা ওষুধ সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত ভাইরাসটির বাহক বা সম্ভাব্য বাহককে অন্যান্য মানুষ থেকে পৃথক করে রাখতে না পারলে এর বিস্তার ঠেকানো একপ্রকার অসম্ভব। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এর প্রতিরোধে যা যা করা যেতে পারে তার সবই আমাদের করা দরকার। খামখেয়ালীপনা বা উদাসীনতার কোনো সুযোগ এখানে নেই।
মুসলিমদের ধর্মীয় জমায়েতের মধ্যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামাত এবং জুমু’আহ ও ঈদের নামায বাদে আর যত রকম কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তার সব আপাতত স্থগিত করে দেওয়া উচিত। আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী উভয়ের তরফ থেকেই দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল আচরণ এক্ষেত্রে কাম্য। করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারলে তখন আবারও এসব কর্মকান্ড পুনরায় শুরু করা যাবে। এই মুহুর্তে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা অধিকতর প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
বাকী রইল মসজিদে জামাতে নামায আদায় করার বিষয়টি। বিজ্ঞ আলেমরা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে কোনো একটি এলাকায় মসজিদে আগত মুসল্লিদের সামগ্রিক অবস্থার জন্য যেটি উত্তম সেই সিদ্ধান্তটি সময়মতো জানাবেন বলে আশা রাখছি। তেমন কোনো ঘোষণা না আসা পর্যন্ত ব্যক্তি মুসলিমের উচিত হবে চিকিৎসক বা তার স্থানীয় সচেতন কোনো আলেমের সাথে পরামর্শ করে সেই অনুযায়ী কাজ করা।
করোনাভাইরাস বিশ্ববাসীর জন্য একটি আযাব কি না তা শতভাগ সঠিকভাবে বলা আমাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আল্লাহই ভালো জানেন। এখন আমাদের সবার উচিত বেশি বেশি করে তাওবা ও ইস্তিগফার করা। অতীত জীবনের যাবতীয় ভুলত্রুটি ও পদস্খলনের জন্য তাঁর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া। পাপ কাজ যা করছি তা এখনই ছেড়ে দেওয়া। ব্যক্তিগত ইবাদাতে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করা। সেইসাথে, এর বিস্তার রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।